আড়ি পাতার প্রযুক্তি

বাংলাদেশের কাছে ইসরায়েল আড়ি পাতার প্রযুক্তি বিক্রি করবে না বলে দেশটির দৈনিক হারেৎজ-এর বরাত দিয়ে প্রথম আলোয় খবর ছাপা হয়েছে। এ খবরের পেছনে দুটি জ্বলন্ত সত্য আছে, যা নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রথমত, এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো সরকার নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহের জন্য আড়ি পাতার প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ আসায় সেলব্রাইট নামের একটি ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান সেই প্রযুক্তির বিক্রি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেলারুশ, চীন, হংকং, ম্যাকাও, রাশিয়ার ক্ষেত্রেও একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা কোনোভাবেই অভিযোগকে খণ্ডন করে না। কয়েক মাস আগে আল-জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও একই রকম বক্তব্য দিয়েছিলেন। তঁাদের বক্তব্য হলো ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তাই সেখান থেকে প্রযুক্তি কেনারও প্রশ্ন ওঠে না। মন্ত্রীদের দাবি সত্য হলে দেশবাসী স্বস্তিবোধ করতে পারত। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকায় সরকার তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ইসরায়েল থেকে আড়ি পাতার প্রযুক্তি কিনছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশটি এ প্রযুক্তি সরবরাহ করছে। সেলব্রাইটের ওই প্রযুক্তির বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে র্যাব কর্মকর্তারা ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সিঙ্গাপুর সফর করেছেন বলেও প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কেবল সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নয়, হাঙ্গেরিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকেও ইসরায়েলি আড়ি পাতার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রবণতা যত বাড়ছে, নাগরিকদের মৌলিক ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার ততই খর্ব হচ্ছে। সম্প্রতি ইসরায়েলের আরেকটি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ ও তাদের উৎপাদিত পেগাসাস স্পাইওয়্যার নিয়ে বিশ্বজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আড়ি পাতার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও তথ্যপ্রমাণ আছে। পেগাসাস রিপোর্টে বাংলাদেশের কারও নাম না এলেও ভারতে এ নিয়ে তোলপাড় চলছে।
বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকের স্বাধীনতার পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অথচ দেশে রাজনীতিক (প্রধানত বিরোধী দলের), সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের টেলিফোন অহরহ ফাঁস হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তা ছাড়া কারও পক্ষে এটি সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দোহাই দেওয়া হয়; যা প্রধানত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতের মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। এসব ক্ষেত্রে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে আদালতের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু আমাদের এখানে কেউ সেসবের ধার ধারেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাঠপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তাই ঠিক করেন কার বিরুদ্ধে আড়ি পাতা হবে, কার বিরুদ্ধে আড়ি পাতা হবে না। রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ আদায়ের উদ্দশ্যেও টেলিফোন আলাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটছে।
কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের বিরুদ্ধে আড়ি পাতা চলতে পারে না। বাংলাদেশ নিজেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলেই দাবি করে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কেন তার নাগরিকদের শত্রু ভাববে এবং নজরদারির নামে জনগণের ওপর আড়ি পাতবে? আড়ি পাতার এ অপসংস্কৃতি বন্ধ হোক।